গণযোগাযোগ ও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাপা বই ও পত্রপত্রিকা পড়া কমে যাচ্ছে—এটা এখন আর নতুন খবর নয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। সংবাদমাধ্যমে মুদ্রণযুগের অবসান পর্ব শুরু হয়েছে—এমন ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হওয়ার পরও প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেছে।
সুতরাং ছাপা মাধ্যমের সংকট এই ডিজিটাল যুগের বাস্তবতা, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেউ কেউ বলছেন, এই বাস্তবতা দুঃখজনক। তাঁরা সেই সব মানুষ, যাঁরা ছাপা বই বা পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়তে যত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন; কম্পিউটার, ট্যাবলেট, ইলেকট্রনিক বুক রিডার, স্মার্টফোন
ইত্যাদি ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় পড়তে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাঁদের কারও কারও ছাপা বইয়ের প্রতি মোহ আছে, এই জনমে যা কাটবে না বলে তাঁদের মনে হয়।
আরেক পক্ষ বলছে, ছাপা বইপত্রের জগৎ সংকুচিত হলে, এমনকি একপর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তা নিয়ে দুঃখ করার কিছু থাকবে না। কারণ, মানুষ এখন যা কাগজে পড়ছে, তখন তা পড়বে ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায়। কাগজের বইয়ের জায়গা দখল করে নেবে ই–বুক; কাগজের সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ইত্যাদির সব কনটেন্ট পাওয়া যাবে ওয়েব পেজে। অর্থাৎ মানুষের পড়ার অভ্যাসে বড় কোনো হেরফের ঘটবে না। গল্প, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি পড়াও আগের মতোই চলতে থাকবে।
কিন্তু গবেষকেরা দেখতে পাচ্ছেন, মাধ্যম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মধ্যেও বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন ঘটছে। ছাপা মাধ্যমের সব পাঠক ডিজিটাল মাধ্যমে গিয়ে আগের মতো মনোযোগী পাঠক থাকছেন না; পাঠ্যবস্তুর প্রতি তাঁদের ‘অ্যাটেনশন স্প্যান’ বা মনোযোগের দৈর্ঘ্য কমে যাচ্ছে। পাঠক থেকে তাঁরা পরিণত হচ্ছেন শ্রোতায় ও দর্শকে। অর্থাৎ অডিও–ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের পেছনে তাঁরা বেশি সময় ব্যয় করছেন। তাঁরা পড়ছেন কম, দেখছেন ও শুনছেন বেশি।
পাঠকের এই পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ছাপা সংবাদমাধ্যমে আলোকচিত্র, কার্টুন, গ্রাফিকস ইত্যাদি দর্শনীয় উপাদানের ব্যবহার যত বেড়েছে, লিখিত বিষয়ের আকার তত ছোট হতে থেকেছে। ডিজিটাল যুগে এসে যুক্ত হয়েছে অডিও–ভিডিও উপাদান। পাঠ্যবস্তুর প্রতি পাঠকের মনোযোগ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কমেছে এবং আরও কমে যাচ্ছে, বিশেষত নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে দেশে সপ্তাহে এক দিন শুধু আনন্দের জন্য কিছু পড়ে, এমন ৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়ের হার ১৯৮৪ পর্যন্ত ছিল ৮১ শতাংশ। ২০১২ সালে সে হার কমে গিয়ে হয় ৭৬ শতাংশ। ১৩ বছর বয়সীদের মধ্যে ওই একই সময়ে এই হার নেমে আসে ৭০ শতাংশ থেকে ৫৩ শতাংশে। ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে নামে ৬৪ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে। অন্যদিকে যারা ক্লাসের বই ছাড়া আর কিছুই পড়ে না, অর্থাৎ যারা আনন্দের জন্য বই পড়ে না, তাদের হার ক্রমাগত বেড়েছে।
ছেলেমেয়েরা আগে যে সময়টায় আনন্দের জন্য পড়ত, এখন সে সময় কীভাবে ব্যয় করে? বিভিন্ন গবেষণা সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, তারা এখন সে সময় ব্যয় করে নানা ধরনের ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায়। কমনসেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন নামের এক আমেরিকান সংস্থা ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে, তাতে দেখা যায়, আমেরিকায় ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা স্কুল ও হোমওয়ার্কের সময় বাদ দিলে দৈনিক গড়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করে বিভিন্ন ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায়। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই হার আরও বেশি—দৈনিক গড়ে সাড়ে ৮ ঘণ্টার বেশি।
২০১৬ সালে সুইডেনেও স্কুলের ছেলেমেয়েদের ওপর পরিচালিত গবেষণা সমীক্ষায় একই প্রবণতার প্রমাণ মিলেছে। চীন থেকে আসছে ভয়াবহ খবর; সে দেশের কিশোর–কিশোরীদের মধ্যে ‘স্ক্রিন টাইম প্রলিফারেশন’ বা ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় বেশি বেশি সময় কাটানো এমন বেড়েছে যে এর ফলে তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো গবেষণা–সমীক্ষা হয়েছে বলে জানা যায় না। তবে মোটের ওপর একটা ধারণা অবশ্যই করা যায়, বিশেষত স্মার্টফোনের ব্যবহার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার পর। এমনিতেই আমাদের সমাজ ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলোর মতো পড়ুয়া সমাজ কখনোই ছিল না। তবু যে অল্প কিছু মানুষের মধ্যে আনন্দের জন্য বই ও পত্রপত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল এবং এখনো আছে, তা আরও কমতে শুরু করেছে। বিশেষত আমাদের ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়ার অভ্যাস খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। এ লেখার শুরুতে পাঠকের দর্শক–শ্রোতায় রূপান্তরিত হওয়ার প্রবণতার কথা বলেছি; আমাদের সন্তানসন্ততিদের বেলায় হয়তো অচিরেই দেখা যাবে যে তারা পাঠক হচ্ছেই না, বেড়েই উঠছে দর্শক–শ্রোতা হিসেবে। অর্থাৎ জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে যা কিছু পড়তে হয়, তার বাইরে আর কিছু পড়ার অবকাশ তারা পাবে না, আগ্রহও বোধ করবে না। তাদের ‘স্ক্রিন টাইম’–এর বাইরে বিনোদনের জন্য কোনো সময়ই আর থাকবে না।
শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা খুব উদ্বেগের বিষয়। এই উদ্বেগ অত্যন্ত দূরপ্রসারী। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির বেশি বেশি ব্যবহারের ফলে মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে—এমন উদ্বেগের সঙ্গে এবার যোগ হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ। ‘স্ক্রিন টাইম’ বাড়ার সমান্তরালে পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে—এমন আশঙ্কা স্পষ্টভাবে তুলে ধরছেন অনেক বিজ্ঞানী।
মনোবিজ্ঞানী ও মস্তিষ্কবিজ্ঞানীরা ভাষাবিজ্ঞানের জগতে ভালোভাবে প্রবেশ করার পর থেকে মানুষের মস্তিষ্কের অনেক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন ধারণা পাচ্ছেন। ইমেজিং টেকনোলজির অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে বিজ্ঞানীরা আগের তুলনায় অনেক নিবিড়ভাবে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যারিয়্যান উলফ বলছেন, মানুষের মস্তিষ্কের যে আদি গঠন, তাতে এমন কোনো সক্ষমতা ছিল না যে লিখিত শব্দ বা বাক্য পড়ে সে তার অর্থ বুঝবে। কাগজের বুকে কতকগুলো চিহ্ন, ধরা যাক ‘সবুজ’ লেখা দেখে তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠবে একটা রং, যা ওই কাগজের বুকে নেই। মানুষের মস্তিষ্কের এই ক্রিয়ার ক্ষমতা তার আদি গড়নে ছিল না—এ কথা বলছেন ম্যারিয়্যান উলফ। ভাষা মানুষের এক অভূতপূর্ব উদ্ভাবন। হোমো স্যাপিয়েন্সের বয়সের তুলনায় এটা অতিসাম্প্রতিক কালের ঘটনা; ছয়–সাত হাজার বছর আগের। মানুষ যখন থেকে পড়তে ও লিখতে শিখেছে, তখন থেকে তার মস্তিষ্কে এক নতুন ধরনের পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। গত ছয়–সাত হাজার বছরে সে পরিবর্তন একটা সংহত রূপ লাভ করেছে। ম্যারিয়্যান বলছেন, মানুষ ‘রিডিং ব্রেইন’–এর অধিকারী হয়েছে। পৃথিবীর প্রাণিকুলের মধ্যে আর কারোরই এই মস্তিষ্ক নেই, যা গড়ে উঠেছে শুধু পড়তে পড়তেই।
পড়ার সময় মানুষের মস্তিষ্কে যেসব কগনিটিভ ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া হয়, যেসব সংযোগ রচিত হয়, ছবি দেখা ও শব্দ শোনার ফলে তা হয় না। অর্থাৎ অডিও–ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের পেছনেই দিনরাত্রির অধিকাংশ সময় ব্যয় করলে মানুষের মস্তিষ্কের সেই সব কাজকর্ম বন্ধ থাকবে, যেগুলো পড়ার সময় ঘটে। এভাবে মানুষের ‘রিডিং ব্রেইন’ ক্রমে সংকুচিত হতে থাকবে। কয়েক প্রজন্ম পরে হয়তো দেখা যাবে, আমাদের নাতি–নাতনিদের কিছু পড়ে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, তাদের শেখার সক্ষমতা কমে গেছে। এ ধরনের একটা রোগ এখনই আছে, ইংরেজিতে সেটাকে বলে ডিসলেক্সিয়া। ম্যারিয়্যান উলফের মতো বিজ্ঞানী–গবেষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ‘স্ক্রিন টাইম প্রলিফারেশন’ বা ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দার ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ডিসলেক্সিয়ার বিস্তার ঘটতে পারে। এ আশঙ্কা যদি কিছু মাত্রায়ও সত্য হয়, তাহলে বিজ্ঞান–প্রযুক্তির অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে আমরা বিশ্বময় যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও নলেজ–ইকোনমির বিকাশ প্রত্যাশা করছি, তা হতাশায় পর্যবসিত হবে।
সুতরাং আনন্দের জন্য পড়া শুধুই বিনোদনের বিষয় নয়, আমাদের মস্তিষ্কের বিদ্যমান ক্ষমতা রক্ষা করা এবং তা আরও বাড়ানোর সঙ্গেও খুব নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
অবশ্য মস্তিষ্কবিজ্ঞানীদের ‘রিডিং ব্রেইন’ আবিষ্কারের অনেক আগেই অনেক মনীষী বই পড়ার পক্ষে খুব জোরালো প্রণোদনা দিয়ে গেছেন।
নোবেল বিজয়ী রুশ কবি ইয়োসেফ ব্রদস্কির একটা বিখ্যাত উক্তি ছিল এ রকম, ‘বই পোড়ানোর চেয়েও গর্হিত অপরাধ অনেক আছে। সেগুলোর একটা হলো বই না পড়া।’
সুরসিক আমেরিকান সাহিত্যিক মার্ক টোয়াইন বলেছিলেন, যে লোক পড়তে জানে কিন্তু বই পড়ে না, তার সঙ্গে যে লোক পড়তেই জানে না, তার কোনো তফাত নেই।
আর জনপ্রিয় ব্রিটিশ শিশুসাহিত্যিক রোয়াল্ড ডাল টেলিভিশন সেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে সে জায়গায় একটা বুকশেলফ বসানোর জন্য মা–বাবাদের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে গেছেন:
‘সো প্লিজ, ওহ্ প্লিজ, উই বেগ, উই প্রে, গো থ্রো ইয়োর টিভি সেট অ্যাওয়ে, অ্যান্ড ইন ইটস প্লেস ইউ ক্যান ইন্সটল, আ লাভলি বুকশেলফ অন দ্য ওয়াল।’
মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক